Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

সর্ব-শেষ হাল-নাগাদ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

নবজাগরণের প্রেরণায় কৃষি: ‘কৃষকের শীতল ঘর’ – ন্যায্যমূল্যের নিশ্চয়তা ও সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত


প্রকাশন তারিখ : 2025-02-26

সকালের প্রথম কিরণে, যেমন কৃষকের অন্তরে এক উজ্জ্বল স্বপ্নের দীপ্তি জাগে, তেমনি দেশের কৃষিক্ষেত্রেও এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। আজ সকাল ১০:০০ টায় সাভারের রাজালাখ হর্টিকালচার সেন্টারে অনুষ্ঠিত ‘কৃষকের শীতল ঘর – Farmers Mini Cold Storage’ উদ্বোধনী কার্যক্রমে আধুনিক প্রযুক্তি, অটুট সংগ্রাম ও সৃষ্টিশীলতার মিলনে এক নতুন দিগন্তের পথপ্রদর্শন ঘটেছে।

বাংলাদেশের কৃষকদের মুখে দীর্ঘদিন ধরে একেই সমস্যা বিরাজ করে—তাদের পরিশ্রমের সঠিক মূল্য না পাওয়া। প্রতিটি মৌসুমে অতিরিক্ত উৎপাদনের সত্ত্বেও, মধ্যস্বত্বভোগী ও বাজারের অস্থিরতার কারণে কৃষকেরা প্রায়ই তাদের ফসলকে কমমূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হন, যেখানে পরবর্তীতে একই ফসল উচ্চ মূল্যে বিক্রি হয়ে থাকে। এই অসঙ্গতির সমাধানে ‘কৃষকের শীতল ঘর’ উদ্যোগ একটি যুগান্তকারী সমাধান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে, যা কৃষকদের জন্য ন্যায্যমূল্যের নিশ্চয়তা ও দীর্ঘমেয়াদি বাজার স্থিতিশীলতা প্রদান করবে।

এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হল—কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্যকে আধুনিক শীতল সংরক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে সঠিক সময়ে বাজারে বিক্রি করা। এর ফলে, মৌসুমি দামের উত্থান-পতন নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে, ফসলের অপচয় রোধ হবে এবং কৃষকদের আর্থিক ক্ষতির আশংকা কমবে। সরাসরি বাজারে তাঁদের পণ্য ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করার সুযোগ কৃষকদের মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমিয়ে সামগ্রিক বাজার ব্যবস্থাকে সুসংহত করবে।

রাজালাখ হর্টিকালচার সেন্টারে ইতোমধ্যে দুটি মিনি কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন করা হয়েছে। একটি ঘরকে আধুনিক কোল্ড স্টোরেজে রূপান্তরিত করা হয়েছে, অপরটি হলো কনটেইনারভিত্তিক এবং সোলার চালিত। বর্তমানে কৃষকরা টমেটো, শসা, লাউ, বিটরুট, ক্যাপসিকাম, বেগুন, গাজর, ফুলকপি সহ নানা ধরনের শাকসবজি ও ফলাদি সংরক্ষণ করতে শুরু করেছেন, যার ফলে ফসলের গুণগতমান বজায় থাকবে এবং বাজারে সঠিক মূল্য অর্জনের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।

এই প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন কৃষকদের জন্য এক অনন্য সুযোগের দ্বার খুলে দিয়েছে। তাঁদের উৎপাদিত পণ্যকে সংরক্ষণ করে চাহিদা অনুযায়ী বিক্রয়ের মাধ্যমে, কৃষকরা বাজারের দামের ওঠানামার চাপ থেকে মুক্তি পেতে পারবেন। ফলস্বরূপ, উৎপাদন খরচ নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং দীর্ঘমেয়াদি বাজার স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে, যা দেশের কৃষিক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।

উদ্বোধনী কার্যক্রমে উপস্থিত প্রধান অতিথি, লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) – মাননীয় উপদেষ্টা, কৃষি মন্ত্রণালয়, এই উদ্যোগকে বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। তাঁর উক্তিতে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়, “এই মিনি কোল্ড স্টোরেজ উদ্যোগ কৃষকদের ফসল সংরক্ষণে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। কৃষকের পরিশ্রম ও আত্মত্যাগকে যথার্থ মূল্য দেওয়ার মাধ্যমে আমাদের দেশের কৃষিক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটবে।”

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন কৃষি সংশ্লিষ্ট খাতের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও, যাদের বক্তব্যে উদ্যোগের সুফল ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছিল। কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান ব্যাখ্যা করেন, “কৃষকের শীতল ঘর কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা ফসলের অপচয় কমাতে এবং কৃষকদের লাভজনক উৎপাদনের সুযোগ বৃদ্ধি করতে চাই। এটি কৃষকদের আর্থিক স্বনির্ভরতায় বিশেষ অবদান রাখবে।” একইভাবে, মহাপরিচালক মোঃ ছাইফুল আলম জানিয়েছেন, “কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সব সময় কৃষকদের সহায়তায় নিবেদিত। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে কৃষকরা দীর্ঘ সময় ধরে তাঁদের সংরক্ষিত পণ্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন এবং ন্যায্যমূল্যে বিক্রয়ের সুবিধা গ্রহণ করতে সক্ষম হবেন।”

উদ্যোগ বাস্তবায়নে কাজ করা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক তালহা জুবাইর মাসরুরও মন্তব্যে জানিয়েছেন, “এই কোল্ড স্টোরেজ প্রযুক্তি আমাদের কৃষকদের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে। স্থানীয় ও আমেরিকান হাইটেক ডিভাইস ব্যবহারের মাধ্যমে নির্মিত, স্বল্প ব্যয়ে, পরিবেশবান্ধব ও পোর্টেবল এই সমাধানটি ফসল সংরক্ষণে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে। ইন্টারনেট-ভিত্তিক এবং রিয়েল-টাইম মনিটরিং সুবিধা থাকায় মোবাইলের মাধ্যমে ঘরে বসে এই মিনি কোল্ড স্টোরেজ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মাত্র ৫ লাখ টাকা খরচে কৃষক নিজের বাড়িতেই এই মিনি কোল্ড স্টোরেজ তৈরি করতে পারবেন, যেখানে কনটেইনারে সোলার বেসড পোর্টেবল কোল্ড স্টোরেজের জন্য প্রায় ১৫ লাখ টাকা খরচ হবে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে সাধারণ কোল্ড স্টোরেজের তুলনায় ৬০-৭০% খরচ কমে যায়; এভাবে অপারেশন করা অনেক সহজ এবং কোনো জটিলতার সম্মুখীন হতে হয় না।”

এই উদ্যোগ কৃষকদের প্রতি সরকারের অটুট প্রতিশ্রুতি ও সহায়তার স্পষ্ট পরিচায়ক। বর্তমান বাজার ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাবের বিরুদ্ধে কার্যকরী ও প্রগতিশীল প্রতিক্রিয়া হিসেবে ‘কৃষকের শীতল ঘর’ আগামী দিনে দেশের প্রতিটি উপজেলায় কমপক্ষে একটি করে স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে। সরকার ও বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে এই প্রযুক্তিকে সহজলভ্য করে, কৃষকদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে যাতে তাঁরা নিজ নিজ এলাকার বাজারে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হন।

এই কার্যক্রমের মাধ্যমে শুধু কৃষকদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে না, বরং দেশের কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাকেও এক নতুন দিক প্রদান করা হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি সম্ভাবনা বৃদ্ধির জন্য সংরক্ষণ পদ্ধতির মানোন্নয়ন ও কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ভবিষ্যতে কৃষিক্ষেত্রে আরো ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সহায়ক হবে।

আজকের এই উদ্ভাবনী পদক্ষেপ কৃষকদের জীবনে যে আশার নতুন আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে, তা এক নতুন কৃষি বিপ্লবের সূচনা। কৃষকদের প্রচণ্ড পরিশ্রম, আত্মত্যাগ ও অবিচল প্রত্যয়ের বিনিময়ে ‘কৃষকের শীতল ঘর’ কার্যক্রম দেশের কৃষিক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা ও ন্যায্যমূল্যের নিশ্চয়তা প্রদান করবে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে কৃষকরা শুধু বর্তমান সংকট থেকে মুক্তি পাবে না, বরং ভবিষ্যতের জন্য তাঁদের উৎপাদনের সঠিক মূল্য নির্ধারণে সক্ষম হবেন।

এই মিনি কোল্ড স্টোরেজ কার্যক্রম কৃষকের স্বপ্নকে নতুন প্রাণদান করে, তাঁদের শ্রমের যথার্থ মূল্য নিশ্চিত করে এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তার পথ সুসংহত করে। তবে, এই উন্নত প্রযুক্তি গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি কোণে পৌঁছে দেয়া অপরিহার্য। সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতায় পরিবেশবান্ধব ও আধুনিক প্রযুক্তির দ্রুত সম্প্রসারণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কৃষকের মুখে হাসি ফিরে আসে, কৃষি লাভজনক হয় এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তার বুনিয়াদ দৃঢ় হয়।